'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' গানটির কথা ও সুর যেকোন বাঙালির কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই তার স্মৃতিতে স্পষ্টতর ভেসে উঠে বিষাদময় অথচ প্রবল অনুপ্রেরণার সেই দিনের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা দিনপঞ্জিতে ৮ ফাল্গুন। ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের গুলিতে বাঙালি অকুতোভয় বীরদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া হয়ত বায়ান্নর আগেই বাঙালির এই বীরত্ব গাঁথা আপন দিনলিপিতে লাল অক্ষরে লিখে রেখেছিল। তাইতো প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে কালো পথে রক্তিম ফুল ফোটে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে।এই ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে।তবুও নিজ সুবিধার্থে দুই একটা কথা বললে বোধহয় অতিকথন হবে না। এই দিনটি বাঙালি জাতির মায়ের ভাষাকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে তুলে ধরার দৃঢ় প্রত্যয়ের দিন। এই দিনে বুকে দুর্দমনীয় সাহস নিয়ে শত্রুর গুলির সামনে দাড়িয়েছিল বাঙালি মায়ের বীর সন্তানেরা। মুহুর্তেই রাজপথ হয়েছিল রক্তে রঞ্জিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে কোনো জাতিকে প্রাণ দিতে হলো। সেদিনেই বাংলার দামাল ছেলেরা নির্যাতিত বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বীজ রোপন করেছিল। ৭১ এ দেশকে করেছিল শত্রুমুক্ত।
১৯৪৮ সালে তৎকালিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কার্জন হলে যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, "উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা" তখনই উপস্থিত ছাত্ররা সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে "না, না" বলে প্রতিবাদ করেছিল। ছাত্রদের সেই বীরত্ব গাঁথা বাঙালিদের জন্য গৌরবের।
কিন্তু হাল আমলের ছাত্র-শিক্ষক কিংবা বুদ্ধিজীবিদের ৪৮ সালের সেইদিনের মত বাংলা ভাষাকে সমুন্নত করার পথে সকল বাধা বিপত্তিকে "না" বলে প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রবাদ আছে, ‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’ বর্তমান সময়ের অবস্থা যেন তারই প্রতিফলন। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে দেশের বুদ্ধিজীবি মহল নড়েচড়ে বসেন, চোখে মুখে দায়িত্বের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ভাষার উন্নয়ন কিভাবে করা যায় গভীর অনুসন্ধান করে তার উপায় বের করেন।রাষ্ট্রীয় নানা কাজে বাংলা ভাষাকে কেন যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। ভাষার মর্যাদাহানিকর নানান বিষয়াবলি খুঁটে খুঁটে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। প্রতিবছর এইদিনে পত্রিকার পাতা ভরে ভরে ভাষার তোয়াজ করা হয়। জায়গা সংকুলানের কারণে হয়ত অনেকেই ভাষার পক্ষে অসাধারণ বক্তব্য জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন না।
কিন্তু একুশ চলে গেলে সকলেই কেমন জানি দায়সারা হয়ে পড়েন। কত আইন, কত নীতির বাস্তবায়নের পরিকল্পনা অতল সাগরে হারিয়ে যায়। তখন গল্পটা হয়ে যায় অনেকটা রাজার দীঘি খননের গল্পের মত। গল্পটা অনেকটা এরকম- রাজ্যের রাজা তার সুনাম বাড়ানোর জন্য রাজ্যে দুধের দীঘি খনন করতে প্রজাদের আদেশ করলেন। রাজার আদেশ অমান্য করার জো নাই। অতএব পুকুর খনন করা হলো। সকল প্রজাকে বলা হলো, তারা যেন প্রত্যেকেই ধবল দুধের একটি কলস দীঘিতে এনে বিসর্জন দেন। দান খয়রাতের বিষয় সামনে আসলে বাঙালির মেধায় নানা কৌশল গিজগিজ করে। মেধার ইন্ধনে এক প্রজা ভাবল, সকলেই তো খাঁটি ধবল দুধের কলসী দান করবে, আমি একজন যদি পানির কলসী ঢেলে দেই তাহলে তা সহস্র সহস্র দুধের কলসীর সঙ্গে অনায়াসেই থাকতে পারবে। রাজ্যের সকল প্রজাই ছিল সমান বুদ্ধিমান, সকলেই প্রথম প্রজার মত চিন্তা করল। একুশ চলে যাওয়ার পরের গল্পটাও এরকম। সকলেই ভাবে এই ক্ষুদ্র দায়িত্ব আমি না নিলেও চলবে। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ভাষার মানোন্নয়নে এগিয়ে আসবেন। ফলে গল্পের মত কেউ বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির জন্য সিকি পরিমাণ দায়িত্ব নিতে পারে না কিংবা এই প্রয়াসকে অরণ্যে রোদন বলেও মনে করেন।
বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার কথা উঠলে তারা নির্দিধায় বলেন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানশাস্ত্র রচনা করা যায় না, অর্থনীতি,দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান জোতিবিজ্ঞানের প্রাথমিক ভাবটুকুও সহজে প্রকাশ করা যায় না। এই কথা নিরেট সত্য বটে। কিন্তু প্রশ্ন করা যায়, ভাষার এই সংকীর্ণতার পেছনে দোষটা আসলে কার? বাংলা ভাষার দোষ নাকি শাস্ত্রের দোষ? উত্তর আসলে কোনটিই না। দোষটা স্বয়ং বাঙালি জাতির। ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। ভাবই যদি না থাকে তাহলে ভাষার সমৃদ্ধি গাছে কাঁঠাল গোফে তেলের মত হয়ে যায়।প্রথমেই ভাবের অন্বেষণ করতে হবে। ভাব থেকে ধ্বনি সৃষ্টি হবে। আকাশ থেকে তো আর বৃষ্টির ধারার মত ধ্বনির বর্ষণ হয় না। সুতরাং আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে কিংবা অন্যের ভাষার দিকে লোভাতুর হয়ে আড় চোখে তাকালে নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি সাধন করতে হলে বিদ্যমান মনস্তত্বাত্তিক ভাবনা প্রক্ষালন করে নব বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে হবে। পুরাতন গ্রীক, ল্যাটিন, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষাসহ যেসব ভাষাকে সমৃদ্ধশালী মনে করা হয় সেসব ভাষা আসলে তাদের নিজস্ব চেষ্টায় সমৃদ্ধ হয়েছে। যে জাতির বস্তুগত অভিজ্ঞতা যত বেশি সে জাতির ভাষা তত সমৃদ্ধ ও বেগমান, তাদের শব্দভান্ডার তত বিস্তৃত। কিন্তু সেই ভাবনা বাঙালির মানসপটে থাকলেও সুনিশ্চিত কসরত করার সদিচ্ছার অভাবে অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষার বইসমূহের একচেটিয়া রাজত্বে বাংলা ভাষার বইসমূহ কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। শিক্ষক মহোদয়গণ সর্বদা শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষার বইয়ের শরণাপন্ন হওয়ার উপদেশ দেন। বাংলা ভাষার পান্ডুলিপিকে তারা এক রকম ঘৃণা করেন। বাধ্যগত শিক্ষার্থীরা তখন নিরুপায় হয়ে ইংরেজি বইয়ের ধর্ণা ধরেন, ভাসা ভাসা কোন রকম ধারণা নিয়ে কিংবা সেটাও সম্ভব না হলে মুখস্থ করে পরীক্ষা কক্ষে বমি করতে করতে ৪/৫ বছর পার করেন। এই সময়ের মধ্যে কোন শিক্ষার্থী বোধহয় দেখেনি, জনৈক শিক্ষক একটি বিদেশি ভাষার বইয়ের বাংলায় ভাবানুবাদের সৎ প্রয়াস চালিয়েছেন। চালালেও তা কতটুকু সফল কিংবা ব্যর্থ হবে তা বলতে না পারলেও নির্দিধায় বলতে পারি ক্ষুদ্র প্রয়াসও তারা চালাননি।
তারা বিট্রিশদের সাম্রাজ্যবাদী সেই নীতির "আমরা এমন একদল মানুষ তৈরি করবো যারা রক্তে মাংসে হবেন এদেশীয় কিন্তু রুচি, শিক্ষাদীক্ষায় তারা হবেন বিট্রিশ মনোভাবাপন্ন" ধারায় আটকে আছেন। তারা শিক্ষার্থীদের ভৎর্সনা করে বলেন, বাংলা ভাষায় দামি দামি তত্ত্বের ভাব সহজে প্রকাশ করা যায় না।
ফলে বাংলা ভাষায় লিখিত স্বল্প সংখ্যক বই গণযোগাযোগ বিদ্যার নীরবতা কুণ্ডলী তত্ত্ব অনুসারে গ্রন্থাগারের পশ্চাদদেশে ধুলোবালির চাদরে ঢাকা পড়ে নিস্তব্ধ হয়ে করুণ জীবন যাপন করেন।
Here I share my experience about current issues aired via media and written topics via The Dailies. And I will try to raise the voice to voiceless. To reach to my destination I really need you beside me. Thanks a lot.
Sunday, February 20, 2022
বাংলা ভাষায় হালের বৃুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক
কয়েকদিন আগে একটি সংবাদমাধ্যম নিউজ করেছে, দেশে পেট্রোল আছে ১১ দিনের আর অকটেন আছে ১৩ দিনের। পরে জানলাম, সাব-এডিটর ভুলবশত এই উপাত্ত দিয়েছে। তা...
-
অর্ধবছর নাগাদ নাড়ীর স্পন্দন অবদমিত রেখে শেষ অবধি ব্যর্থ হলাম। এই ব্যর্থতা কারো জন্য হয়ত হাসির খোরাক হবে কেউ হয়ত ব্যাপারখানা জেনে আমাকে নিতান...
-
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' গানটির কথা ও সুর যেকোন বাঙালির কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্রই তার স্মৃতিতে ...
-
কয়েকদিন আগে একটি সংবাদমাধ্যম নিউজ করেছে, দেশে পেট্রোল আছে ১১ দিনের আর অকটেন আছে ১৩ দিনের। পরে জানলাম, সাব-এডিটর ভুলবশত এই উপাত্ত দিয়েছে। তা...
No comments:
Post a Comment