অর্ধবছর নাগাদ নাড়ীর স্পন্দন অবদমিত রেখে শেষ অবধি ব্যর্থ হলাম। এই ব্যর্থতা কারো জন্য হয়ত হাসির খোরাক হবে কেউ হয়ত ব্যাপারখানা জেনে আমাকে নিতান্ত গর্দভ মনে করবে। সে যাই হোক, আমার গতিতে এসব ভাবনার কোন প্রভাব পড়ে না।
ব্যাগে প্রয়োজনীয় কি নিলাম, কি নিলাম না কিছুই জানি না। তবে হুড়মুড় করে বেরিয়েছি এটুকু সচেতন মস্তিষ্কেই বলতে পারি। লক্ষ্য নৌ-পথে চাঁদপুর আপন ঠিকানা।
লঞ্চের ঘাটে পা রাখতেই কানে ভেসে এলো মিশ্র-দৃঢ় কণ্ঠ। ছাড়ে,,,,,ছাড়ে। আগে,,,,,আগে। সাথে হকারদের হৈ-হুল্লোড় ঘাটের বাতাসকে আরো ভারী করে তুলেছে। তারা অধিকাংশই ফল আর রুটি বিক্রেতা। দেখে মনে হয় একেবারে সস্তায় বিক্রি করছে।
নৌযানে বাস কিংবা ট্রেনের মত প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য জানালার পাশের সীট বরাদ্দের জন্য তদবির প্রয়োজন হয় না। আমারও হলো না। কারণ নৌযানের পুরো জায়গাই আমার।
ঘড়ির কাটা দুটি তখন ১৫০ ডিগ্রি কোণ তৈরী করছে। মানে বিকাল ৫ টা। বিকট শব্দে হর্ণ আর কয়েকশ সিলিন্ডার বিষাক্ত গ্যাস আকাশে ছেড়ে লঞ্চ ঘাট ছাড়ল। মনটা খারাপ হলো।নড়েচড়ে বসলাম।
বুড়িগঙ্গা নদী। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মেগাসিটির অত্যাচারে তার পানি এখন জলজ প্রানীর মৃত্যুর কৃষ্ণ পাঁচন। নদীর দুই পাশে তালতমাল সারি সারি নানা রঙের,নানান ডকের জাহাজ,কিস্তি। দুই পাড়ের হাড়ভাঙ্গা শ্রম আর স্বল্প মজুরীর শ্রমিকের সৃজনশীল নানা ক্রিয়া, ব্যস্ততার শৃঙ্খল দেখতে দেখতে অনেকটুকু পথ সামনে এসেছি। এখন আর রাজধানীর চিত্র মাথায় নেই। ফুটপাতে প্রবাহমান জনস্রোতের প্রতিকূলে কখনো বা অনুকূলে ক্ষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পা ফেলার ফুরসত নেই কিংবা ফুট ওভারব্রিজের ৪ ইঞ্চি প্রশস্ত সিঁড়িতে পিপীলিকার গতিতে এগুনোর সময় স্বীয় পকেটে হাত রেখে পকেটমারকে হতাশ করার জরুরত নেই। একাকিত্ব সবসময় মানুষকে একাকী করে দেয়না। কখনো হয়ত এই একাকিত্বই হয়ে উঠে পছন্দের মানুষকে মনস কল্পনায় শৈল্পিক রূপে সাজানোর সুন্দরতম অবকাশ। সেই অবকাশ আমি পেয়েছি কিনা জানি না। শুধু বলতে পারি ব্যস্ত জীবনের স্মৃতি বিনাশ করেছি। নদীর কোন এক ঘাটে, না ঘাট বলা ঠিক হবে না, নদীসৈকত বলা যেতে পারে, একদল তরুণী অবলীলায় একান্ত আনমনে স্নান করছে। কেউ আবার কারুকার্য খচিত কলসী কাঁখে কোমরে শাড়ি পেছিয়ে আঁচল বুকে ফেলে লোমহর্ষক ভঙ্গিতে পা ফেলছে অবিরত। যারা স্লান করছে সেসব তন্বী যুবতীরা নিতান্ত শিশু মননে লীলাময় দেহে জলের গামলা উপুড় করে দিচ্ছে। মুহুর্তেই পাতলা শাড়ির আবরণে লুকানো পীনস্তন চিরসত্য সৌন্দর্য জগৎ সংসারে প্রকটিত করতে বাধ্য হল। কৃষ্ণ জল এই সৌন্দর্য ছুয়ে আর কৃষ্ণ রইল না।বৃষ্টির পানির ন্যায় স্বচ্ছ শুভ্র হয়ে বহমান জলে মিশে দুর্ভাগা জলবিন্দু গুলোর সঙ্গে বিতর্ক জয়ী হয়ে মেঘনা অভিমুখে খুশিমনে চলছে। গুরুভার নিতম্ববিশিষ্টা স্বাস্থ্যবতী স্নানরত রমণীগণ নির্দিধায় তাঁদের কর্ম সাধনে ব্যস্ত। অথচ তাদের এই কমলার মত ঠোঁট, স্নিগ্ধ চাদনী রাতে পুকুরের জলের ন্যায় কোমরের মৃদু ঢেউ, বক্ষদেশের কম্পন পুরুষ মনকে কতটা আড়োলিত করতে পারে সেই ভাবনা তাদের মনে নেই।
যাই হোক, জলের বর্ণ এখন আর কৃশকায় নয়।মেঘনায় চলে এসেছি। বক,গাঙছিল আর মৎস্য শাবকের খেলা। চিপস উড়ালে সেই খেলার ষোলকলা পূর্ণ করা যায়। এক প্যাকেট চিপস থাকলে বোধহয় তাদেরকে ঘরে নিয়ে আসা যাবে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে জাহাজের হিংস্র দাঁতে চর্বিত কচুরিপানা। দেখলে বেশ মায়া হয়। যদি তাঁরা এমন হিংস্রতার স্বীকার না হত,তাহলে এই সংসারে কত সৌন্দর্যই না বিলাইত!!
চারপাশের নানান বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে কখন যে পথ ফুরিয়ে গেল টের পেলাম না। পাশ থেকে কয়েকটি কণ্ঠ ভেসে এলো। 'ভাই, চলে এসেছেন, নামবেন না?' মাথা নাড়িয়ে নিমে এলাম। দেখলাম,, নৌকায় করে জেলেরা স্বল্পমূল্যে ইলিশ বিক্রি করছে।মানিব্যাগের অবস্থা বেশি ভালো না।চাহিদামত খরিদ করতে পারলাম না। স্বভাবতই ঘাট থেকে বের হয়ে নৌ-ভ্রমনের রোমাঞ্চকর বুলীর শেষ পৃষ্ঠায় মজবুত দাড়ি ফেললাম।